ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ
পর্ব-৫
প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ
যেকোনো নির্মাণ প্রকল্পের ভৌতকাজ বাস্তবায়নকল্পে ব্যবহৃতব্য প্রতিটি কাঁচামালের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, নির্মিতব্য ভবনের কাঠামো বা স্ট্রাকচার নির্মাণ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব মালামাল সঠিকভাবে নির্বাচন করাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ভবনটি সার্বিক প্রতিকূল আবহাওয়ায় টিকে থাকা এবং দীর্ঘস্থায়ী হওয়া সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে এর নির্মাণে ব্যবহৃত প্রতিটি কাঁচামালের গুণগত মান ও কাজের পদ্ধতির ওপর। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এবারের অলোচ্য বিষয় ‘সিমেন্ট’।
‘সিমেন্ট’ শুধু ভবনের কাঠামো বা স্ট্রাকচার নির্মাণেই নয়; পরিপূর্ণ একটি ভবন, রোড, ব্রিজ, কালভার্ট, ড্রেনসহ নির্মাণ সংশ্লিষ্ট সব ধরনের কাজে ব্যবহৃতব্য অন্যতম একটি নির্মাণ উপকরণ। এটি একটি বাইন্ডিং মেটারিয়াল। যেকোনো নির্মাণকাজে সিমেন্টের সঙ্গে সংমিশ্রিত অন্য সব মালামালকে একত্রে জমাটবদ্ধ করে নির্মিত অবকাঠামোকে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চারে সহায়ক উপাদান হিসেবে কাজ করে সিমেন্ট।
ভবন নির্মাণ অতি প্রাচীন ঐতিহ্য। সিমেন্ট আবিষ্কারের আগে এই নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব কাজের জন্য সিমেন্টের পরিবর্তে চুন ব্যবহার করা হতো এবং ভবনগুলো নির্মিত হতো স্বল্প উচ্চতায়। মানবসভ্যতার ধারাবাহিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন ঘটছে আর্থসামাজিক অবস্থার। ফলে মানুষের চাহিদা বাড়ছে, বাড়ছে জনসংখ্যা। ক্রমবর্ধমান এই জনসংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে সমগ্র বিশ্বে তৈরি হচ্ছে বহুতলবিশিষ্ট ভবন এবং অধিক সংখ্যক রোড, ব্রিজ, কালভার্ট, ড্রেন ইত্যাদি।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও জনসংখ্যা ও আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় অতীতে বহুতল ভবন নির্মাণের প্রচলন ছিল অতি নগণ্য। ফলে, দেশের বিদ্যমান চাহিদা মোতাবেক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত কাঁচামাল ও প্রযুক্তির ব্যবহারে সর্বোচ্চ দুই বা তিনতলা বিশিষ্ট ব্রিক বিল্ডিং নির্মাণ করা হতো। বর্তমান বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করণার্থে প্রতিনিয়ত উদ্ভাবিত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি, যা ব্যবহার করে নির্মিত হচ্ছে আকাশচুম্বী সব ভবন।
মানুষের চাহিদা ও জ্ঞানের প্রসার বেড়েছে, বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। তারই ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশেও এখন বহুতলবিশিষ্ট ভবন নির্মিত হচ্ছে। এই ভবনসমূহের সার্বিক সহনশীলতা ও দীর্ঘস্থায়িত্বতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সিমেন্টের সার্বিক গুণগত মান রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। প্রথমত, বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত বিভিন্ন মানের সিমেন্টের সঠিক গুণাগুণ যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, সিমেন্টের সুষ্ঠু সংরক্ষণ, প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার এবং ব্যবহারসংক্রান্ত নিয়মাবলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মেনে চলা দরকার।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাংলাদেশে একসময় শুধু সিলেট জেলার ছাতক এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত দুটো সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে সিমেন্ট উৎপাদন করা হতো। যাতে দেশের সমগ্র নির্মাণকাজের চাহিদা পূরণ করতে না পারায় বিদেশ থেকে সিমেন্ট আমদানি করার প্রয়োজন দেখা দিত। বর্তমানে আমাদের দেশে নতুন নতুন অনেক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি তৈরি হয়েছে, যেখান থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রচুর পরিমাণ সিমেন্ট এবং তা দিয়েই পূরণ হচ্ছে দেশীয় সিমেন্টের সার্বিক চাহিদা।
নব নির্মিত এসব সিমেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে বিভিন্ন মানের সিমেন্ট উৎপাদন করা হয়ে থাকে। তাই গুণগত মানসম্পন্ন সিমেন্ট নির্বাচন করতে আমাদের অধিক সচেতন হওয়া দরকার। দরকার সিমেন্টের প্রকারভেদ এবং এদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যথার্থ ওয়াকিবহাল হওয়া। ব্যবহারভেদে সিমেন্ট প্রধানত দুই প্রকার:
১. হোয়াইট সিমেন্ট ও
২. গ্রে-সিমেন্ট।
গ্রে-সিমেন্ট আবার দুই ভাগে বিভক্ত:
১. ওপিসি বা অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট ও
২. পিসিসি বা পোর্টল্যান্ড কম্পোজিট সিমেন্ট।
উল্লেখ্য, ফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত প্রতিটি সিমেন্টকেই সাধারণভাবে পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট বলা হয়ে থাকে। এই পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের কাজ বা ব্যবহারের ধরন এবং কেমিক্যাল প্রোপার্টি বিশ্লেষণে উপরোল্লিখিত প্রকারভেদ ছাড়াও আরও অনেক প্রকারভেদ আছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
১. অর্ডিনারি পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
২. এয়ার এন্ট্রেনিং পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
৩. এক্সপ্যান্ডিং পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
৪. র্যাপিড হার্ডেনিং পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
৫. কুইক সেটিং পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
৬. লো-হিট পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট
৭. সালফেট রেজিস্টিং পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট প্রভৃতি।
যা-ই হোক, সাধারণ নির্মাণ কিংবা আমাদের দৈনন্দিন কাজে সাধারণত হোয়াইট সিমেন্ট ও গ্রে-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। গ্রে-সিমেন্ট মূলত যেকোনো ভবন নির্মাণকল্পে কংক্রিট ঢালাইয়ের প্রধান উপাদান। এ ছাড়া প্লাস্টারসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজেও গ্রে-সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়। সব ধরনের নির্মাণকাজেই গ্রে-সিমেন্টই অধিক পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, হোয়াইট সিমেন্ট শুধু নান্দনিক কিংবা শৈল্পিক কাজে ব্যবহার করা হয়। হোয়াইট সিমেন্টের দাম গ্রে-সিমেন্টের তুলনায় ৩ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত বেশি।
হোয়াইট সিমেন্ট
আগেই বলা হয়েছে, হোয়াইট সিমেন্ট শুধু নান্দনিক তথা শৈল্পিক কাজে ব্যবহার করা হয়। এসব কাজের মধ্যে ফ্লোর ফিনিশিং (কাস্ট-ইন-সিটু মোজাইক ঢালাই করা কিংবা মোজাইক টালি তৈরি করা, সিরামিক টালির জয়েন্ট ফিলিং করা) এবং নানা ধরনের সারফেস ট্রিটমেন্ট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ইদানীং আমাদের দেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ফেয়ার ফেস কংক্রিট ব্যবহারে ভবনের বহির্দেয়ালসমূহ নির্মিত হচ্ছে, যেখানে কংক্রিট ঢালাইয়ের জন্য হোয়াইট সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়।
গ্রে-সিমেন্ট
গ্রে-সিমেন্ট প্রধানত কংক্রিট ঢালাই ও প্লাস্টারের কাজে ব্যবহার করা হয়। তাই একটি ভবন নির্মাণ প্রকল্পের মোট প্রয়োজনের প্রায় ৯৫ শতাংশই গ্রে-সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এ ছাড়া রোড, ব্রিজ, কালভার্ট, ড্রেন ইত্যাদি সব ধরনের নির্মাণ প্রকল্পেই কংক্রিট ঢালাই করা এবং প্লাস্টারের কাজে গ্রে-সিমেন্ট ব্যবহৃত হয়। ফলে, নির্মিতব্য যেকোনো স্ট্রাকচার কিংবা ইনফ্রাস্ট্রাকচারের গুণগত মান রক্ষা ও দীর্ঘস্থায়িত্বতা নিশ্চিত করণার্থে সিমেন্টের গুণগত মান নিশ্চিত করা অপরিহার্য একটি বিষয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নির্মাণশিল্পের অন্যতম একটি উপাদান গ্রে-সিমেন্ট এবং এই সিমেন্টেরই গুণাগুণ সম্পর্কিত নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যা কাজের আগে যাচাই করে নেওয়া জরুরি। অতএব, সিমেন্টের নির্ধারিত বৈশিষ্ট্যসমূহ নিশ্চিতভাবে যাচাই করার জন্য ব্যবহৃতব্য সিমেন্ট থেকে স্যাম্পল কালেকশন করে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করা প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে যে যে টেস্ট করতে হবে তা হলো:
১. ফাইননেস টেস্ট
২. সেটিং টাইম টেস্ট
-ইনিশিয়াল সেটিং টাইম টেস্ট ও
-ফাইনাল সেটিং টাইম টেস্ট
৩. সাউন্ডনেস টেস্ট
৪. কেমিক্যাল কম্পোজিশন টেস্ট
৫. স্ট্রেইন্থ টেস্ট
-কম্প্রেসিভ স্ট্রেইন্থ টেস্ট ও
-টেনসাইল স্ট্রেইন্থ টেস্ট।
উপরোল্লিখিত প্রতিটি টেস্টের জন্য এএসটিএম (আমেরিকান সোসাইটি ফর টেস্টিং অ্যান্ড মেটারিয়ালস) এবং বিএসটিআই (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন) কর্তৃক নির্দিষ্ট কিছু প্যারামিটার দেওয়া আছে, যা মেনে চলা অত্যাবশ্যক।
সিমেন্ট সংরক্ষণ
যেকোনো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নার্থে সংগৃহীত সিমেন্ট সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ করার বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। কারণ, আবহাওয়ার পরিবর্তনজনিত কারণে সিমেন্ট অত্যন্ত সংবেদনশীল। আবহাওয়ার পরিবর্তন অর্থাৎ বাতাসের তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার তারতম্যে সিমেন্টের সার্বিক গুণাগুণ লোপ পেতে পারে, যা কাজের গুণগত মান রক্ষায় ব্যত্যয় সৃষ্টির করে। তাই মনে রাখা দরকার, সিমেন্ট সংরক্ষণের নিয়মনীতি মেনে চলতে ন্যূনতম অবহেলাও একটি স্ট্রাকচারের বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সুতরাং, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে বের করার আগেই এর সুষ্ঠু সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। নিয়মানুযায়ী সব ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করে সিমেন্ট পরিবহন ও সংরক্ষণ করতে কোনোরকম অবহেলা করা যাবে না। সিমেন্ট সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো মেনে চলা অপরিহার্য-
- সিমেন্ট সংরক্ষণের জায়গা শুষ্ক হতে হবে
- সিমেন্টের গুদাম বায়ুনিরোধক হতে হবে
- মাটি কিংবা ফ্লোর হতে ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি উঁচু মাঁচা করে তার ওপর সিমেন্টের বস্তা রাখতে হবে
- গুদামের দেয়ালের পাশে ৬ থেকে ১২ ইঞ্চি ফাঁকা রেখে সিমেন্টের বস্তা সাজাতে হবে
- দীর্ঘ সময়ের জন্য সিমেন্ট সংরক্ষণ করা সঠিক নয়
- আগে সংগৃহীত সিমেন্ট আগে ব্যবহার করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে
- উন্মুক্ত বা খোলা আকাশের নিচে সিমেন্ট রাখা সমীচীন নয়।
ডি.জি.এম. (কিউ.এ) অ্যান্ড এম.আর.
দি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লি. (এসইএল)