ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ: পর্ব-৯ – অ্যালুমিনিয়াম, মোজাইক ও টাইলস

ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ: পর্ব-৯ - অ্যালুমিনিয়াম, মোজাইক ও টাইলস

ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ

পর্ব-৯

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ

ভবন নির্মাণ এবং মান নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনায় আজকের বিষয় ‘অ্যালুমিনিয়াম, মোজাইক ও টাইলস।

অ্যালুমিনিয়াম

বর্তমান বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকার ভবন নির্মাণ প্রকল্পের কাজে কাঠের বিকল্প হিসেবে অ্যালুমিনিয়াম অন্যতম একটি উপকরণ। অতীতে নির্মিত আবাসিক-অনাবাসিক সব ধরনের ইমারতের ক্ষেত্রেই জানালা-দরজা তৈরি করার জন্য কাঠের ব্যবহারই ছিল মুখ্য। প্রযুক্তিগত উন্নতি, ব্যবহারিক সুবিধা, উপকরণসমূহের দীর্ঘস্থায়িত্বতা এবং বিদ্যমান বাজারে কাঠের উচ্চমূল্য ও দুষ্প্রাপ্যতা বিবেচনায় এসব কাজের জন্য অ্যালুমিনিয়ামের ব্যবহার শুধু বৃদ্ধিই পায়নি বরং কাজগুলো অ্যালুমিনিয়াম-নির্ভর হয়ে গেছে, সেটা বলাই বাহুল্য।

আবাসিক-অনাবাসিক সব ধরনের ইমারতেরই জানালা তৈরির ক্ষেত্রে সর্বত্রই অ্যালুমিনিয়াম ফ্রেমের মাধ্যমে কাচের পাল্লা ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ছাড়া স্লাইডিং দরজা, ল্যুভারড দরজা, ফোল্ডেড শিটেট সলিড দরজা এবং ফিক্সড পার্টিশন ওয়াল নির্মাণের কাজেও অ্যালুমিনিয়াম ব্যবহার করা হয়। বর্তমান বাজারে বিভিন্ন কোম্পানি কর্তৃক উৎপাদিত বিভিন্ন কোয়ালিটির অ্যালুমিনিয়াম সেকশনসহ এ সংক্রান্ত অন্য সব মালামাল পাওয়া যায়। ফলে, উপরোল্লিখিত সব কাজের ক্ষেত্রেই সঠিক মালামাল নির্বাচন ও কাজের কোয়ালিটি নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এসব কাজে অ্যালুমিনিয়াম সেকশনের গুণগত মানের পাশাপাশি তালা (লক) ও চাকা (হুইল) এগুলোর গুণগতমান ভালো হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, এই দুটি জিনিসের মান খারাপ হলে ব্যবহারিক স্বাচ্ছন্দ্যতা থাকে না, থাকে না নিরাপত্তাও। দুর্বল কিংবা নষ্ট তালার (লক) কারণে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং চাকা (হুইল) নিম্ন মানের হলে দ্রুত নষ্ট হয়ে পাল্লা অচল হয়ে পড়ে। অতএব ভালো মানের জিনিস ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। দাম একটু বেশি হলেও এর দীর্ঘস্থায়িত্বতা বিষয়টি পুষিয়ে দেয়।   

মোজাইক 

মোজাইক অতি প্রাচীন একটি বিল্ডিং ম্যাটেরিয়ালস। অতীতে এর বহুল প্রচলন থাকলেও বর্তমানকালে মোজাইকের ব্যবহার বিলুপ্তপ্রায়। মোজাইক সাধারণত ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। নির্মাণপদ্ধতিভেদে মোজাইকের কাজ দুভাবে সম্পন্ন করা হয়ে থাকে- ১. সিটু মোজাইট ও ২. মোজাইক টাইলস। সরাসরি ফ্লোরের ওপর ঢালাই করে যে মোজাইক ফিনিশিং দেওয়া হয়, তাকে ‘সিটু মোজাইক’ বলা হয় এবং বিভিন্ন সাইজ ও নকশা অনুযায়ী অন্যত্র প্রস্তুত করে ফ্লোরে বসানো মোজাইককে ‘মোজাইক টাইলস’ বলে। 

সিটু কিংবা টাইলস উভয় প্রকার মোজাইকই সাধারণত ১ : ১ অনুপাতে মার্বেল চিপস ও সিমেন্টের মিশ্রণ দ্বারা ঢালাই করে প্রস্তুত করা হয়। এই মোজাইক প্রস্তুতের কাজ বেশ শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুলও বটে। তবে এর দীর্ঘস্থায়িত্বতা অনেক বেশি। মোজাইক ঢালাইয়ের কাজে হোয়াইট ও গ্রে দুই ধরনের সিমেন্টই ব্যবহার করা যেতে পারে। মার্বেল চিপসেরও বিভিন্ন ধরন ও কোয়ালিটি আছে, আছে তদ্নুযায়ী দামের পার্থক্যও। ফলে, অত্র কাজের জন্য মালামাল নির্বাচনের বিষয়টি ব্যবহারকারীর রুচি এবং আর্থিক সামর্থ্যরে ওপর নির্ভরশীল।

‘সিটু মোজাইক’-এর পুরুত্ব খুবই কম (৩/৮ ইঞ্চি) হয়ে থাকে, তাই মোজাইক ঢালাই করতে সম্পূর্ণ এলাকাটিকে ছোট ছোট প্যানেলে ভাগ করে নিতে হয়। নইলে সারফেসে ফাটল দেখা দেয় এবং মোজাইকের স্থায়িত্বতা কমে যায়। এই প্যানেল তৈরির জন্য সাধারণত গ্লাসের স্ট্রিপ ব্যবহার করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্রাশ বা পিতলের স্ট্রিপও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রয়োজনীয় প্যানেল তৈরির শেষে প্রথমে ১ ইঞ্চি পুরু প্যাটেন্ট স্টোন (সিমেন্ট, বালি ও ৩/৮ ইঞ্চি ডাউন গ্রেডেড ব্রিক/স্টোন চিপস ব্যবহারে ১ : ২ : ৪ অনুপাতে ১ ইঞ্চি পুরু সি.সি.) ঢালাই করে পৃষ্ঠদেশ আনফিনিশড অবস্থায় রাখা হয়। প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাই শক্ত হওয়ার পর অন্তত তিন দিন কিউরিং করার পর মার্বেল চিপস ও সিমেন্ট মিশ্রণের মাধ্যমে মোজাইক ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়।

আগেই বলা হয়েছে, এই কাজটি বেশ শ্রমসাধ্য ও ব্যয়বহুল। কাজটি সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে ধাপে ধাপে এগোতে হয়, যার পর্যায়ক্রমিক ধাপগুলো হলো:

  • পূর্বে ঢালাইকৃত আরসিসি ফ্লোর ভালোমতো চিপিং করা 
  • আলগা ময়লা-মাটি পরিষ্কার করা এবং পানি দিয়ে ওয়াশ করা
  • ফিনিশিং লেভেল নির্ধারণ করে নকশা মোতাবেক গ্লাস স্ট্রিপ বসানো 
  • মোজাইক টপিংয়ের জায়গা খালি রেখে প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাই করা 
  • প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাইয়ের পর ভালোমতো কিউরিং করা
  • মোজাইক টপিং (১ : ১ অনুপাতে মার্বেল চিপস ও সিমেন্ট) ঢালাই করা
  • মোজাইক ঢালাই করার পর কমপক্ষে ২১ দিন কিউরিং করা
  • কাটিং মেশিন দ্বারা ঢালাইকৃত মোজাইকের টপ সারফেস কেটে লেভেল করা
  • মোজাইক কাটিং পাথর ও সিরিশ কাগজ দ্বারা হাতে কেটে ফিনিশিং দেওয়া এবং 
  • অ্যাসিড ও মোম পলিশ করা ইত্যাদি। 

মোজাইক নির্মাণসংশ্লিষ্ট সব কাজই সুদক্ষ কারিগর ও সুষ্ঠু তদারকির মাধ্যমে করানো প্রয়োজন। ব্যবহৃতব্য মালামাল এবং কাজের গুণগতমান ভালো হওয়া জরুরি। মার্বেল চিপস, সিমেন্ট, মোজাইক কাটার পাথর, সিরিশ কাগজ, অ্যাসিড, মোম সব কিছুরই গুণাগুণ ও মানের তারতম্য অনেক। ফলে, পুরো কাজের মান ও স্থায়িত্বতা নির্ভর করে ব্যবহৃতব্য মালামাল ও কাজের গুণগত মানের ওপর। তাই প্রয়োজনীয় মালামাল নির্বাচন ও কাজের তদারকির ব্যাপারে ব্যবহারকারী কর্তৃক সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যাবশ্যক। 

সঠিক পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করার ব্যাপারে অভিজ্ঞ মিস্ত্রির কোনো বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে প্রয়োজন অভিজ্ঞ লোকবল দ্বারা সুষ্ঠু তদারকি নিশ্চিত করা। প্যাটেন্ট স্টোন ঢালাইয়ের কাজটি পূর্বে আলোচিত নিয়ম অনুযায়ী হওয়া জরুরি। মোজাইক টপিংয়ের কাজের জন্য মার্বেল চিপস চালনিতে চেলে ডাস্ট ফ্রি করা এবং অন্যান্য ময়লা-আবর্জনা থাকলে তা পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ওয়াশ করে নেওয়া অপরিহার্য। মোজাইকের কাজে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন রঙের মার্বেল চিপস পাওয়া যায়, যা মিশ্রণ করে নিজেদের ইচ্ছামতো নকশা প্রস্তুত করা যেতে পারে।

নির্মিতব্য মোজাইকের নির্বাচিত কালার অনুসারে বিভিন্ন ধরনের চিপসের অনুপাত ঠিক করে তা মিশিয়ে নেওয়ার পর সিমেন্ট ও চিপস ১ : ১ অনুপাতে শুকনো অবস্থায় ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হয়। অতঃপর অল্প অল্প করে পানি দিয়ে সব মালামাল একত্রে মিলিয়ে ঢালাইয়ের কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ঢালাই মেলানোর সময় পানির পরিমাণটা অবশ্যই লক্ষণীয়। মিস্ত্রিরা সাধারণত তাঁদের কাজের তাৎক্ষণিক সুবিধার্থে অধিক পানি ব্যবহার করে থাকেন, যা কাজের মান রক্ষায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে মোজাইকের স্থায়িত্বতা কমিয়ে দেয়। 

মোজাইক ঢালাই শেষ করার ১০ ঘণ্টা পর অত্র এলাকায় পানি আটকিয়ে কমপক্ষে ২১ দিন পর্যন্ত কিউরিং করা জরুরি। প্রয়োজনীয় কিউরিং শেষে মোজাইক কাটা মেশিনে বিভিন্ন সাইজের (৪০, ৬০, ৮০, ১২০ নম্বর নামে নানা ধরনের পাথর বাজারে পাওয়া যায়) পাথর ব্যবহার করে সারফেস ফিনিশিং দিতে হয়। মেশিনে কাটা শেষ হলে পুনরায় পাথর ও সিরিশ কাগজ ব্যবহারের মাধ্যমে হাতে কেটে ফিনিশিং দিতে হয়। সবশেষে, অ্যাসিড ও মোম পলিশ করা হয়, যাতে মসৃণ ও চকচকে ব্যবহারের উপযোগী একটি অবস্থার সৃষ্টি করে। 

মোজাইক ফ্লোরের চারদিকের দেয়ালেও ৬ ইঞ্চি উচ্চতা পর্যন্ত মোজাইক করা হয়, যাকে স্কার্টিং বলে। এ ছাড়া কোনো লন এবং টয়লেট/বাথরুমের ফ্লোর ও দেয়ালেও মোজাইক করা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লে¬খ্য, খাড়া দেয়ালের মোজাইক কাটার জন্য মেশিন ব্যবহার করা যায় না, এক্ষেত্রে পাথর ও সিরিশ কাগজ দ্বারা হাতে কেটে ফিনিশিং দিতে হয়। এতবিধ ঝামেলাপূর্ণ এবং ব্যয় ও শ্রমসাধ্য কাজের কারণেই বর্তমানে সর্বত্রই মোজাইকের স্থলে সিরামিক টাইলস স্থান করে নিয়েছে।

টাইলস

ফ্লোর ফিনিশিংয়ের কাজে এখন টাইলসই প্রধান উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মোজাইকের কাজের দীর্ঘসূত্রতা, ও ব্যয়বহুলতা এবং টাইলসের সহজলভ্যতা ও কাজের সুবিধাই এর প্রধান কারণ। টাইলস বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। যেমন: গ্রানাইট, মার্বেল, মোজাইক, সিরামিক টাইলস ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে সিরামিক টাইলস ব্যবহারের প্রচলনই বেশি। কারণ হিসেবে কম দামের বিষয়টিই উল্লেখযোগ্য। কিন্তু সিরামিক টাইলস দিয়ে ফ্লোর নির্মাণে ব্যয় যেমন কম, তেমন এর স্থায়িত্বতা তুলনামূলকভাবে কম। 

গুণগতমান, স্থায়িত্বতা ও উচ্চমূল্যের ক্রমানুসারে এসব টাইলসের তালিকায় রয়েছে:

১. গ্রানাইট

২. মার্বেল

৩. মোজাইক এবং

৪. সিরামিক টাইলস।

তবে কিছু কিছু বিদেশি সিরামিক টাইলস আছে, যার দাম আনুপাতিক হারে বেশি হলেও সৌন্দর্য ও স্থায়িত্বতাও অনেক বেশি। টাইলস ব্যবহার করে ফ্লোর নির্মাণের কর্মপদ্ধতি এবং রক্ষণাবেক্ষণের কাজ সিটু মোজাইকের তুলনায় অনেক সহজ। টাইলস বসানোর কর্মপদ্ধতি-আরসিসি ঢালাইকৃত ফ্লোরের ওপর ১ : ৩ অনুপাতে সিমেন্ট ও বালুর মসলা তুলনামূলকভাবে শুকনো অবস্থায় বিছিয়ে তার ওপর সিমেন্ট গ্রাউট দিয়ে টালি বসানো হয়। এই কাজটি করার আগে আরসিসি ফ্লোর ভালোভাবে চিপিং করে পানি দিয়ে ওয়াশ করে নেওয়াটা জরুরি।

টালি বসানোর ১০ ঘণ্টা পর থেকে কমপক্ষে ৭ দিন কিউরিং করে জয়েন্টগুলো শুধু সাদা সিমেন্ট কিংবা সিমেন্টের সঙ্গে টালির রং অনুযায়ী রং মিশিয়ে পয়েন্টিং করে ব্যবহারের উপযোগী করতে হয়। অত্র কাজগুলো মোজাইকের কাজের তুলনায় অনেক কম সময়ে সম্পন্ন করা সম্ভব। টাইলসের ফ্লোর তুলনামূলকভাবে একটু পিচ্ছিল হয়, ফলে চলাফেরায় সাবধান হওয়া জরুরি। টাইলস ফ্লোর পরিষ্কার করা সহজ এবং পরিষ্কার করার জন্য বাজারে নানা রকম ডিটারজেন্ট পাওয়া যায়, যা ব্যবহারে কম শ্রমে অধিক ফল পাওয়া সম্ভব।

ডি.জি.এম. (কিউ.এ) অ্যান্ড এম.আর. 

দি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লি. (এস.ই.এল.) 

Previous Part: কাঠ ও কাচের ব্যবহার | ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ: পর্ব-৮

Overview