ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ
প্রথম পর্ব
প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ
‘নির্মাণ’ কথাটি খুবই ছোট। তবে, এর কর্মপরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন-প্রক্রিয়া বিশদ। প্রবাদ আছে, ‘ভাঙা সহজ, গড়া কঠিন’। কিন্তু, নির্মাণ সংক্রান্ত একটি বইয়ের প্রচ্ছদে দেখেছিলাম, ‘স্থাপনা নির্মাণ সহজ কাজ’। লেখকের এই উক্তিটির সঙ্গে আমি আদৌ একমত হতে পারিনি। কারণ, আমার জানা আর দেখা মতে, সব নিয়মকানুন ও বিধিনিষেধ মেনে টেকসই এবং সার্বিকভাবে গুণগত মানসম্মত একটি স্থাপনা নির্মাণ করতে চাইলে এটি অত্যন্ত কঠিন একটি কাজই শুধু নয়, বরং বড় একটি কর্মযজ্ঞের মধ্যে নিপতিত হওয়া। ফলে, নির্মাণসংক্রান্ত প্রতিটি পদক্ষেপ চিন্তাপ্রসূত এবং সঠিক হওয়া বাঞ্ছনীয়।
তাই, স্থাপনা নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই প্রতিটি কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও উপলব্ধি থাকা অত্যাবশ্যক। সেই সঙ্গে প্রয়োজন, এতদ্সংক্রান্ত সব কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিবেচনাধীন বিষয়গুলো মাথায় রেখে নির্মাণবিষয়ক সব কাজ সম্পাদন করা। নইলে পরবর্তী সময়ে যেসব ত্রুটিবিচ্যুতি কিংবা বিপদের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে, তার খেসারত দিতে হয় ইমারতে বসবাসকারীসহ আশপাশের সবাইকে।
প্রসঙ্গত, একটি স্থাপনা নির্মাণকারী স্বয়ং অত্র ইমারতে বসবাসকারী নাও হতে পারে। এমন ক্ষেত্রে নিজেকে বসবাসকারী চিন্তা করেই নির্মাণকাজ সম্পাদন করা জরুরি। এখানে অবশ্যই নীতিনৈতিকতার প্রশ্ন এসে যায় এবং মানুষ হিসেবে সব বিষয়ে নিয়মনীতি মেনে চলাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই নির্মাণকাজের জন্য বিধিবদ্ধ কিছু নিয়মকানুন এবং বাধানিষেধ সম্পর্কিত সম্যক কিছু ধারণা দিতে এবং তা মেনে চলতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াসে আমার এই লেখা।
সাম্প্রতিককালে ঢাকা শহরে ভবন ধসে পড়া এবং ভবনে আগুন লেগে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি করার মতো কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার পরবর্তী কারণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্থাপনাগুলো নির্মাণকালে যথাযথ নিয়ম মেনে চলা এবং কাজের কোয়ালিটি সংক্রান্ত বিষয়গুলো উপেক্ষিত ছিল। ফলে, নির্মাণ সংক্রান্ত ত্রুটি ও অনিয়মই এসব দুর্ঘটনা ঘটার পেছনে প্রধান কারণ বলে প্রতীয়মাণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রতিটি দেশেই নির্মাণকাজের সার্বিক কোয়ালিটি নিশ্চিত করণার্থে কিছু নিয়মকানুন ও বিধিনিষেধ আছে এবং আছে তা মেনে চলার জন্য নাগরিক সচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট আইনের কঠিন প্রয়োগ।
আমাদের দেশেও তদ্রুপ নিয়মনীতি, আইনকানুন, বিধিনিষেধ কোনো কিছুরই কমতি নেই, নেই শুধু নাগরিক সচেতনতা ও আইনের যথাযথ প্রয়োগ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রাজউক কর্তৃক নিয়ন্ত্রণাধীন ‘স্থাপনা নির্মাণ বিধিমালা’ এবং জাতীয় পর্যায়ে প্রণীত ‘বিএনবিসি’ স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্পের প্রধান গাইড। যেখানে নির্মাণসংক্রান্ত আইনকানুন, নিয়মনীতি, বিধিনিষেধ সবকিছুই সবিস্তারে বিবৃত আছে এবং আছে সেগুলো মেনে চলার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কিত নির্দেশনাবলি। এ ছাড়া একটি স্থাপনা নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন করার আগে বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। সেখানেও নানা ধরনের বিধিনিষেধ বিবেচনায় নিয়েই ছাড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে।
এত কিছুর পরও শুধু তদারকি আর জবাবদিহির অভাবে নানাবিধ সমস্যা ও দুর্ভোগের শিকার হতে হয় সাধারণ মানুষকে। প্রাচীন প্রবাদ, ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন ঘটনাই ঘটে। কাজের সঙ্গে কাগজ কিংবা কথার কোনো মিল থাকে না। ফলে, কখনো কখনো বিভিন্ন রকম বিড়ম্বনা ও মহা দুর্যোগ নেমে আসে জনজীবনে। মনে রাখা দরকার, একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর বৃথা আস্ফালন আর ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার সময়ও আমাদের হয় না। তাৎক্ষণিক কিছু ক্রিয়া-প্রক্রিয়া দেখানোর পর সবকিছু শান্ত হয়ে যায়।
আমাদের এই অসচেতনতা থেকে বেরিয়ে এসে স্থাপনা নির্মাণকাজের জন্য প্রণীত সব নিয়মনীতি ও বিধিনিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলে পরিবেশবান্ধব এবং মানসম্মত স্থাপনা নির্মাণ করা অত্যাবশ্যক। এ লক্ষ্যে, নির্মাণকারী ব্যক্তি/সংস্থা, কাজ তদারককারী ব্যক্তি/সংস্থা এবং স্থাপনা নির্মাণ প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নের কাজের নিয়মনীতি ও মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করণার্থে রেগুলেটরি সংস্থাসমূহের সচেতন হওয়া অতীব জরুরি। প্রয়োজনে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করে সব অনিয়ম বন্ধ করা দরকার। দরকার নির্মাণসংক্রান্ত সার্বিক কোয়ালিটি নিশ্চিত করা।
প্রসঙ্গত, একটি কোয়ালিটি সম্পন্ন স্থাপনা নির্মাণকল্পে ব্যবহৃতব্য মালামাল ও যন্ত্রপাতি এবং নিয়োজিত লোকবল ও কাজের পদ্ধতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোয়ালিটি রক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই। উল্লেখ্য, আবাসিক-অনাবাসিক সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণকল্পেই বিভিন্ন ব্যাপারে নির্ধারিত কিছু নিয়মনীতি এবং বিধিনিষেধ আছে, যা সঠিকভাবে মেনে চলতে ব্যর্থ হলে স্থাপনার স্থায়িত্ব, গুণগত মান এবং বসবাসের উপযোগিতা লোপ পাওয়াসহ স্থাপনাটি অচিরেই ক্ষতি কিংবা ঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারে।
অতএব, একটি টেকসই ও গুণগত মানসম্মত স্থাপনা নির্মাণকাজ বাস্তবায়নকালে যে প্রধান চারটি বিষয় বিবেচনায় আনা জরুরি তা হচ্ছে-
১. মালামাল
২. যন্ত্রপাতি
৩. লোকবল ও
৪. কাজের পদ্ধতি।
উল্লেখিত বিষয়গুলোর প্রথম তিনটির ব্যাপারে সবাই মোটামুটি সচেতন থাকলেও চতুর্থটি অর্থাৎ পদ্ধতিগত ব্যাপারে আমাদের সচেতনতার অভাব আছে, আছে অভিজ্ঞ লোকবলের অভাব। তাই, এই পদ্ধতিগত বিষয়টির গুণাগুণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সব কাজে দক্ষ ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক দ্বারা সার্বক্ষণিক তদারক করানোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
লেখক: প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ