টেকসই স্থাপনা নির্মাণের চার প্রধান বিষয় – ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ – পর্ব ২

sustainable construction quality control part-2

ভবন নির্মাণ ও মান নিয়ন্ত্রণ

দ্বিতীয় পর্ব

প্রকৌশলী মো. হাফিজুর রহমান, পিইঞ্জ

টেকসই ও গুণগত মানসম্মত একটি ভবন নির্মাণকাজ বাস্তবায়নকালে যে প্রধান চারটি বিষয় (মালামাল, যন্ত্রপাতি, লোকবল ও কাজের পদ্ধতি)-এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়, তা ধারাবাহিকভাবে আলোচিত হলো-

১। মালামাল

একটি ভবনের স্ট্রাকচার বা কাঠামো নির্মাণকল্পে ব্যবহৃতব্য মালামাল (ইট, পাথর, রড, সিমেন্ট, বালু ইত্যাদি) অবশ্যই গুণগত মানসম্পন্ন হতে হবে। বর্তমানে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে নির্মাণসামগ্রীর সার্বিক চাহিদা বিবেচনা করে বিভিন্ন মান ও দামের নানা ধরনের মালামাল বাজারে বিদ্যমান। সঙ্গে আছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী, যারা নিজেদের ফায়দার কথা চিন্তা করে অনভিজ্ঞ ও নিরীহ জনসাধারণকে ঠকানোর জন্য সদা উন্মুখ থাকে। চটকদার কিছু কথাবার্তা বলে বেশি দামে নিম্নমানের মালামাল গছিয়ে দিয়ে অধিক মুনাফা লুটতে চায় নির্মাণপণ্যের এই ব্যবসায়ীরা। যার ভবিষ্যৎ কুফল ভোগ করতে হয় ক্রেতা বা ভোক্তা সাধারণকে। আমাদের দেশে অবস্থাভেদে ৫০ থেকে ১০০ বছর লাইফ টাইম ধরে একটি ভবনের ডিজাইন করা হয় এবং ভবনের এই লাইফ টাইম সার্বিকভাবে নির্ভর করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নকালে ব্যবহৃত মালামালের গুণগত মান ও কাজের পদ্ধতির ওপর।

সুতরাং যেকোনো ভবন নির্মাণকল্পে মালামাল সংগ্রহ করতে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ জনবল, যে কি না চোখে দেখেই অত্র মালামালের গুণগত মান ৭০-৮০ শতাংশ পর্যন্ত নিশ্চিত করতে সক্ষম। আর বাকি ২০ শতাংশ অর্থাৎ ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করণার্থে নির্বাচিত মালামালের স্যাম্পল কালেকশন করে ল্যাব টেস্টে পাঠাতে হবে। উল্লেখিত প্রতিটি মালের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য নির্দিষ্ট কিছু প্যারামিটার আছে, যার সঙ্গে ল্যাব টেস্টের ফলাফল মিলিয়ে নিতে হবে।

এ ছাড়া, মালামাল সংগ্রহের পর নির্মাণ-পূর্ববর্তী সময়ে তার সুষ্ঠু সংরক্ষণও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রসঙ্গত, ইট, পাথর, বালু ইত্যাদি মালামালগুলো যাতে কাদা-মাটি কিংবা তেল-ময়লাজাতীয় পদার্থের সঙ্গে মিশ্রিত হতে না পারে সে বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা সঙ্গে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। রড ও সিমেন্ট উন্মুক্ত আবহাওয়ায় অধিক সময় রাখা বাঞ্ছনীয় নয়, এ ক্ষেত্রে রডে মরিচা ধরা এবং সিমেন্ট জমাট বেঁধে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।

মনে রাখা দরকার, ইট, পাথর ও বালুর সঙ্গে কাদা-মাটি কিংবা তেল-ময়লা জাতীয় পদার্থের সংমিশ্রণ, রডে মরিচা ধরা এবং সিমেন্ট জমাট বেঁধে যাওয়া ইত্যাদি বিষয় নির্মিতব্য ভবনের গুণগত মান রক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করে। ফলে ভবনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও স্থায়িত্বতা লোপ পেয়ে সময়ের পরিক্রমা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেওয়াসহ ভবনটি ধসে পড়ার মতো বিপর্যয়ও নেমে আসতে পারে।

অতএব, একটি ভবন নির্মাণকল্পে উল্লেখিত মালামালগুলো সংগ্রহ করার সময় অবশ্যই সর্বাধিক মানসম্পন্ন মালামাল সংগ্রহ করা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে নির্মাণ-পূর্ববর্তী সময়ের জন্য উল্লেখিত মালামালগুলোর সুষ্ঠু সংরক্ষণব্যবস্থাও। তাহলেই মজবুত ও দীর্ঘস্থায়ী একটি স্ট্রাকচার বা কাঠামো নির্মাণ নিশ্চিত করা যাবে এবং নির্ভয় ও নিশ্চিন্তে থাকা যাবে নির্মিত স্ট্রাকচার বা কাঠামোটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকার ব্যাপারে।

এ ছাড়া, স্ট্রাকচার বা কাঠামো নির্মাণ-পরবর্তী অভ্যন্তরীণ সার্ভিস কানেকশনসমূহ যথাÑ বিদ্যুৎ সঞ্চালন, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন ইত্যাদি কাজের জন্য ব্যবহৃতব্য মালামাল যেমন-বৈদ্যুতিক তার, পাইপ প্রতিটি জিনিসের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি, ফিনিশিং আইটেম-প্লাস্টার, ফ্লোর ফিনিশ, গ্রিল, অ্যালুমিনিয়াম, গ্লাস, পেইন্ট, পলিশ ফিটিং-ফিক্সাচারস (ইলেকট্রিক ও স্যানিটারি) সবকিছুরই গুণগত মান নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

নইলে, নির্মিত ভবনটি চিরতরের জন্য ত্রুটিপূর্ণ হয়ে থাকবে এবং অত্র ভবনে বসবাসকারী ব্যক্তিবর্গের জন্য কখন কোন বিড়ম্বনা নেমে আসবে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। আত্মসচেতন কোনো ব্যক্তির জন্য এ ধরনের পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। যদিও আমাদের সমাজের অধিকাংশ মানুষই এত সব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামায় না বা ঘামাতে চায় না। তারপরও আমি বলতে চাই, অত্র বিষয়গুলো নিয়ে প্রত্যেকেরই মাথা ঘামানো উচিত।

তাই, বর্তমান বাজারে বিভিন্ন মালামাল কেনার ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে সংশ্লিষ্ট সবাই অনুধাবন করতে পারবেন আমাদের সমস্যাটা কোথায়? যেহেতু সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণে আমার এ সংক্রান্ত মালামালের মান সম্পর্কে সম্যক কিছু ধারণা আছে। ফলে অনেক সময় বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে অনভিজ্ঞ ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভালো-মন্দ বাছ-বিচার করার সময় প্রায়ই তিক্ততার সৃষ্টি হয়।

কোনো কোনো ব্যবসায়ীর ক্ষেত্রে এমনটি হয় যে তাদের কাছে যেটা থাকে সেটাই সর্বোৎকৃষ্ট, এর থেকে ভালো জিনিস বাজারে নেই এ ধরনের নানা কথা বলে ক্রেতাকে আটকানোর চেষ্টা করে। অথচ, আপনি ওখান থেকে বেরিয়ে পাশের দোকানে গেলেই হয়তো ওর থেকে ভালো মানের জিনিস তুলনামূলক কম দামেও ক্রয় করতে পারেন। ফলে, যেকোনো মালামাল ভালো-মন্দ যাচাই করে নেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা ও মানসিকতা থাকতে হবে সংশ্লিষ্ট সবার।

২। যন্ত্রপাতি

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে, ‘ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, নিধীরাম সরদার’, অর্থাৎ যুদ্ধ জয় করতে হলে ঢাল, তলোয়ারের প্রয়োজন পড়ে। তদ্রুপ, নির্মাণকাজের গুণগত মান নিশ্চিত করার জন্য যন্ত্রপাতি দরকার হয়। যদিও আমাদের দেশে একসময় কোনো যন্ত্রপাতি ছাড়াই নির্মাণকাজ পরিচালিত হয়ে এসেছে। যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্টের প্রয়োজন হতো না। একজন ভালো রাজমিস্ত্রি একাই নির্মাণসংক্রান্ত সব কাজ পরিচালনা করত। ভবন নির্মাণকল্পে সব মালামাল ও কাজ সম্পর্কে তারা যেটা বলত, সেটাই হতো। এমনকি ভবনের নকশাও অনেক ক্ষেত্রে তারাই সরেজমিনে করে দিত।

বর্তমানে, আমাদের শিক্ষা-দীক্ষা, কারিগরি সুযোগ-সুবিধা অনেক কিছুই বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে যেকোনো ভবন নির্মাণকাজের গুণগত মান নিশ্চিত করণার্থে প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী জোগাড় করার পাশাপাশি এতদ্সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি জোগাড় করার বিষয়টিও নিশ্চিত করা জরুরি। মনে রাখা দরকার, নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি করার পাশাপাশি কাজকে সহজ করে দেয় এবং সময় ও খরচ সাশ্রয় করে।

ফলে, একটি ভবনের স্ট্রাকচার বা কাঠামো নির্মাণ করতে কংক্রিট মেশানো এবং কম্প্যাকশন করার জন্য ১. মিক্সার মেশিন ও ২. ভাইব্রেটর মেশিন থাকা অত্যাবশ্যকীয়। নইলে, নির্মিতব্য কংক্রিটের যথার্থ মান রক্ষা করা কঠিন হতে পারে। উল্লেখ্য, কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজে কংক্রিট মেশানোর সময় এর প্রধান উপাদান সিমেন্ট, বালু ও খোয়া, এগুলো সর্বতো সমানভাবে মেশানো এবং নিয়মমাফিক ভাইব্রেটর চালিয়ে সমান ও সুষ্ঠুভাবে কম্প্যাকশন করার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা জরুরি, অন্যথায় নির্মিত স্ট্রাকচার বা কাঠামোটি দুর্বল হয়ে পড়বে।

এ ছাড়া, নির্মিত কংক্রিটের গুণাগুণ বিশ্লেষেণকল্পে স্লাম্প কোণ এবং ল্যাবরেটরি টেস্টের স্যাম্পল নেওয়ার জন্য কংক্রিট মোল্ড থাকা অত্যাবশ্যক। একটি ভবনের মেইন স্ট্রাকচার বা কাঠামো নির্মাণে অন্যতম কাজ কংক্রিট ঢালাই করা, যেখানে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এ লক্ষ্যে, বালু-খোয়ার পরিমাণ ঠিক রাখার জন্য মিজারিং বক্স, পানি মাপার জন্য বালতি, ভালো মানের শাটারিং মালামাল ইত্যাদি থাকা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে।

ডিজিএম (কিউএ), এমআর অ্যান্ড হেড অব মেইনটেইনেন্স সেকশন
দি স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার্স লি. (এসইএল)

Overview

Related Post